November 22, 2024, 5:58 pm
দৈনিক কুষ্টিয়া অনলাইন/
বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে উদ্ভূত পরিস্থিতির মধ্যে সংঘাত-সহিংসতায় প্রায় ৬৫০ জনের মৃত্যুর তথ্য পেয়েছে জাতিসংঘ। সংস্থাটির মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিহতদের মধ্যে শিশুর সংখ্যা ৩২। বিক্ষোভ দমাতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক অপ্রয়োজনীয় বলপ্রয়োগের বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগও পাওয়া গেছে।
‘বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বিক্ষোভ ও অস্থিরতা বিষয়ে প্রাথমিক বিশ্লেষণ’ শিরোনামে ১০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনটি গতকাল প্রকাশ করে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশন। প্রতিবেদনের একটা অনুচ্ছেদে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অপ্রয়োজনীয় বলপ্রয়োগ ও বিচারবহির্ভূত হত্যার তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, গণমাধ্যম ও আন্দোলনে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের তথ্য অনুযায়ী, ১৬ জুলাই থেকে ১১ আগস্টের মধ্যে ৬৫০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ১৬ জুলাই থেকে ৪ আগস্টের মধ্যে প্রায় ৪০০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। আর ৫ থেকে ৬ আগস্টের পর বিক্ষোভের নতুন প্রবাহে মৃত্যু হয় প্রায় ২৫০ জনের। এরপরও এখনো চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরো মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, নিহতের এ সংখ্যা বাস্তবে আরো বেশি হতে পারে। কারণ আন্দোলন চলাকালে কারফিউ ও ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় নির্বিঘ্নে তথ্য সংগ্রহ করা যায়নি। আবার হাসপাতালগুলোকে হতাহতের বিষয়ে তথ্য দিতে সরকারের পক্ষ থেকে বাধা দেয়ার খবরও পাওয়া গেছে। নিহতদের মধ্যে শিশু, শিক্ষার্থী, বিক্ষোভকারী, পথচারী, সাংবাদিক ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য রয়েছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, জুলাইয়ের শুরুতে সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা-সংক্রান্ত একটি রায়ের পর প্রতিবাদ শুরু করেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তারা শান্তিপূর্ণভাবে নিজেদের ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেন। বিক্ষোভের জের ধরে সরকারের উচ্চপর্যায়ের একজন তাদের ‘রাজাকার’ সম্বোধন করলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এ আন্দোলনের জন্য বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীকে দায়ী করেন এবং তাদের দমনে ছাত্রলীগই যথেষ্ট মর্মে বক্তব্য দেন। তার বক্তব্যের পর সরকারদলীয় এ ছাত্র সংগঠন ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে সংঘাত দেখা দেয়। বিশেষ করে ১৫ জুলাই আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ। এরপর তারা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আহতদের ওপর দ্বিতীয় দফায় হামলা চালায়। হামলায় ছাত্রলীগ বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্র ও রিভলবারসহ নানা আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে। এসব অস্ত্র ব্যবহারে পুলিশ অথবা সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেয়া অথবা নিরুৎসাহিতও করা হয়নি।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ঘটনা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে ১৬ জুলাই, যখন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী পুলিশের গুলিতে নিহত হন। আবু সাঈদ নামের ওই শিক্ষার্থীকে পুলিশ খুব কাছ থেকে গুলি করে। এদিন দেশব্যাপী বিক্ষোভ আরো তীব্র হয়ে ওঠে। এরপর বডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এবং র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) গুরুতর মানবাধিকর লঙ্ঘন করে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৮ জুলাই শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সমর্থন জানায় বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন এবং ট্রেড ইউনিয়নসহ বেশকিছু সংস্থা। এর মধ্যে বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিও রয়েছে। কিন্তু সরকার বিএনপির রাজনৈতিক শরিক জামায়াতে ইসলামীকে স্বাধীনতাবিরোধী আখ্যা দিয়ে এ আন্দোলনের পেছনের শক্তি বলে দাবি করে। তাদের এ দাবির ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ আরো বেশি ছড়িয়ে পড়ে। ওইদিন সরকার সারা দেশে ব্রডব্যান্ড ও মোবাইল ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেয়। যেটি কার্যত সব ধরনের অনলাইন যোগাযোগ ব্যবস্থার ‘শাটডাউন’ করা হয়। একই সঙ্গে বাংলাদেশের বাইরে মোবাইল কলের মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থাও ব্যাহত হয়। সরকার এর কারণ হিসেবে ডাটা সেন্টার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার যুক্তি দেখায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯ জুলাই শেখ হাসিনা জরুরি বৈঠক ডাকেন। বৈঠকের পর তিনি বিশেষ ক্ষমতাবলে দেশে কারফিউ জারি করেন। এরপর ২২ জুলাই উচ্চ আদালত এক রায়ে বলেন, সরকারি চাকরিতে ৯৩ শতাংশ নিয়োগ হবে মেধার ভিত্তিতে। ৫ শতাংশ নিয়োগ হবে মুক্তিযোদ্ধা কোটায়। ১ শতাংশ করে রাখা হয় প্রতিবন্ধী ও সমাজের পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর জন্য। কিন্তু আন্দোলনকারীরা বিগত এক সপ্তাহের গণহত্যার দায়ে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমা চাওয়াসহ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সড়ক ও যোগাযোগমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী ও আইনমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২২ জুলাই ইন্টারনেট বন্ধ থাকা অবস্থায় বিএনপি ও জামায়াতের নেতাদের লক্ষ্য করে গ্রেফতার অভিযান চালানো হয়। আটকদের বেশির ভাগকেই ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে উপস্থিত না করে মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হয়। তাদের পক্ষে কোনো আইনজীবী দাঁড়ানোর সুযোগ দেয়া হয়নি এবং তাদের আটকের বিষয়ে পরিবারকেও জানার সুযোগ দেয়া হয়নি। এ সময়ে অন্তত ২৮৬টি মামলা হয়। আসামি করা হয় ৪ লাখ ৫০ হাজার মানুষকে। আটক হয় দুই হাজারের বেশি মানুষ।
আন্দোলন দমনে ২৪ জুলাই সীমান্ত থেকে বিপুল পরিমাণ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। এ বিষয়ে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়, আন্দোলন দমনে মিয়ানমার সীমান্ত থেকে এক-তৃতীয়াংশ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যকে ঢাকায় আন্দোলন দমনে নিয়ে আসা হয়। এতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এসব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও সঠিক বিচারের আশ্বাস দিয়েছেন। জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন সরকারের ওপর আস্থা রাখছে এবং সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিচ্ছে।
Leave a Reply